সেই সন্তোষের মায়ের জন্য মন্ত্রীর এক লাখ টাকা উপহার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মৌলভীবাজারের শমসেরনগরের সেই সন্তোষের মা কমলি রবিদাসের জন্য এক লক্ষ টাকা ‘উপহার’ হিসেবে পাঠিয়েছেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান। মন্ত্রীর পক্ষ থেকে রবিবার বিকেলে মৌলভীবাজার জেলার জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান সন্তোষের হাতে এই অর্থ তুলে দেন। এ সময় কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিফাত উদ্দিন ছাড়াও জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে ১৭ আগস্ট সকালে সরকারি খাদ্য সহায়তা নিয়ে সন্তোষদের বাড়ি গিয়েছিলেন সিফাত উদ্দিন।

ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মৌলভীবাজারের ডিসি স্যার আমাকে নিউজটা হোয়াটসঅ্যাপে দিয়ে এই মা ছেলের ব্যাপারে খোঁজ নিতে বললেন। আমি তাঁদের বাসায় গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে চালডালসহ বেশ কিছু খাবার দিয়েছি। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁর মায়ের চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তাও দিয়েছি। আজ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ডিসি মহোদয় মন্ত্রীর পক্ষ থেকে সন্তোষের হাতে টাকাটা তুলে দিয়েছেন। ’

জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে বের হওয়ার পর মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান সন্তোষের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেছেন। কী বলেছেন মন্ত্রী? সন্তোষ বললেন, “মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, ‘টাকাটা ব্যাংকে রেখে দিবে। ভবিষ্যতে তোমার মায়ের জন্য খরচ করবে। ’ এখন আমি ব্যাংকে মায়ের নামে একাউন্ট করে টাকাটা রেখে দেবো। মা যখন প্রয়োজন মনে করবেন ব্যবহার করতে পারবেন। ”

সন্ধ্যায় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিও ফোন করে সন্তোষের খোঁজখবর নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে সন্তোষ বলেন, ‘সবশুনে তিনি (শিক্ষামন্ত্রী) আমাকে জীবনবৃত্তান্ত পাঠাতে বলেছেন। ’

মৌলভীবাজারের শমসেরনগরে ফাঁড়ি কানিহাটি চা বাগানের এক শ্রমিক পরিবারে জন্ম সন্তোষ রবিদাস অঞ্জনের। জন্মের মাস ছয়েকের মাথায় বাবাকে হারিয়েছিলেন। মা কমলি রবিদাস চা বাগানের শ্রমিক। তখন মজুরি পেতেন দৈনিক ১৮টাকা। সেই সময় ছেলেকে অন্যের বাসায় রেখে তিনি চলে যেতেন চা বাগানে। ২০০৭ সালে সন্তোষ তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। তাঁর মা কমলি রবিদাসের মজুরি তখন মাত্র ৮৮টাকা।   সে সময় ৫ কেজি চালে প্রায় এক মাস চলেছে তাদের। কুপি বাতির আলোয় পড়তেন সন্তোষ। দোকানদার বাকিতে তেল দিত না। ফলে তেল শেষ হয়ে গেলে সেদিন আর পড়া হতো না।

ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছেন সন্তোষ। ২০১৩  সালে ভর্তি হয়েছিলেন বিএএফ শাহীন কলেজে। তখন সন্তোষের মায়ের মজুরি ছিল ১০২ টাকা। তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ছেলের ভর্তির টাকা, ইউনিফর্ম আর আর বই-খাতা কিনে দিয়েছিলেন। ২০১৪ ডিসেম্বরে ছিল সন্তোষের এইচএসসির রেজিস্ট্রেশন। তাঁর মা কমলি রবিদাস তখন ৫০ টাকার একটা নোট দিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলেছিলেন—‘কেউ ধার দেয়নিরে বাপ। ’ কলেজের এক শিক্ষকের কাছ থেকে ধার নিয়ে সেবার রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়েছিলেন সন্তোষ। এইচএসির পর ভর্তি পরীক্ষার কোচিং। কমলি তখন আবার লোন নিলেন ব্যাংক থেকে। লোনের কিস্তি শোধের জন্য বাসা থেকে অনেক দূরে গিয়ে বালু শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। প্রায় দিনই ঘরে চাল থাকতো না। কেবল আলু খেয়েই অনেক বেলা কাটিয়েছিলেন কমলি। একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে পড়ার সুযোগ পেলেন সন্তোষ। বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশনি করেই চলতেন। উৎসব-পার্বণে কখনো একটা নতুন জামা কেনা হয়নি তাঁর। এখনো প্রতিদিন সকালে একটা বোতলে লবণ, চা-পাতা ভর্তা, আটার রুটি, সামান্য ভাত পলিথিনে ভরে নিজের পাতি তোলার গামছায় মুড়িয়ে কমলি দৌঁড়ান চা বাগানের পানে। ৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করে মজুরি পান মাত্র ১২০ টাকা!

মা-ছেলের এই সংগ্রামের গল্প নিয়ে ১৬ আগস্ট মঙ্গলবার একটি ফিচার প্রকাশিত হয়েছিল অবসরের পাতায়। শিরোনাম ‘মায়ের নামটা কেটে দিল’। পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ প্রতিবেদনটি শেয়ার দিয়ে এই মাকে ‘স্যালুট’ জানিয়েছে। কালের কণ্ঠে প্রকাশিত লেখার সূত্র ধরে অনেকেই সন্তোষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তিনি চাকরির অফার পেয়েছেন আনোয়ার গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ, যমুনা গ্রুপ, ম্যাক্সন গ্রুপসহ বেশ কয়েকটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে। দেশি-বিদেশি এনজিও থেকে চাকরির অফার পেয়েছেন এই তরুণ।

গত ১৮ আগস্ট এ নিয়ে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় । শিরোনাম ‘সন্তোষের ঘরে সন্তুষ্টি নিয়ে এলো চাকরি’। এ প্রসঙ্গে আনোয়ার গ্রুপের সিনিয়র ম্যানেজার (মানবসম্পদ) এবং ইউনিট এইচআর (সিমেন্ট ডিভিশন) প্রধান মনোজ কুমার সাহা বলেন, ‘ লেখাটা পড়ে আমরা সন্তোষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তার জন্য একটা চাকরির সুপারিশ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছি। বিষয়টা তাদের বিবেচনাধীন। ’

ছেলে চাকরি পেতে যাচ্ছে শুনে খুশি সন্তোষের মা কমলি রবিদাস। তিনি বললেন, ‘বাচ্চা (সন্তোষ) যদি ভালা কোনো রুজি (চাকরি) পায় তাহলে আমার সুখ অইবো। ’

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর